নিজস্ব প্রতিবেদক: এইচ.এম.বিল্লাল হোসেন রাজু
স্বজনহারা মানুষের অশ্রুতে সিক্ত হলো কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বর। সন্তানহারা মা, নিখোঁজ বাবার সন্তান, তুলে নিয়ে গেছে এমন ভাইয়ের বোন, বেহদিস স্বামীর স্ত্রীসহ এমন অনেকের কান্নায় আজ শুক্রবার সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পরিবেশ ছিল বেদনাবিধুর। তাঁরা সমবেত হয়েছিলেন আপনজনদের ফিরে পাওয়ার দাবি নিয়ে।
অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে স্বজনহারা মানুষেরা জানতে চান, স্বজনেরা কোথায় আছেন? কেমন আছেন? বেঁচে আছেন কি না? মেরে ফেলা হলে কোথায় তাঁদের কবর দেওয়া হয়েছে? তাঁরা বলেন, বাংলাদেশে যেন আর কোনো অজুহাতেই এমন অমানবিক গুমের ঘটনা না ঘটে। একজন মানুষও যেন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার না হন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে গুম হওয়া স্বজনদের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’ আজ আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে মানববন্ধন ও সমাবেশের আয়োজন করে। সেখানেই তারা এসব কথা বলে। তাদের সঙ্গে সেখানে গুম অবস্থা থেকে সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া মাইকেল চাকমা, সাবেক কূটনীতিক মারুফ জামান, সংগীতশিল্পী রানা যোগ দিয়ে নিজেদের গুম হওয়ার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন।
গুম হওয়া ব্যক্তিদের ছবি নিয়ে স্বজনেরা দীর্ঘ মানববন্ধন করেছেন শহীদ মিনার চত্বরে। তাঁদের কারও সন্তান ১৩ বছর ধরে নিখোঁজ, কারও বাবাকে তুলে নেওয়া হয়েছিল এক যুগ আগে। কারও স্বামীকে গুম করা হয়েছে ১০ বছর আগে। এমন অনেক পরিবার এই দীর্ঘ সময় ধরে তাদের অবর্ণনীয় মানসিক যন্ত্রণা, আতঙ্ক, আর্থিক ও নানা ধরনের ক্ষতি এবং হয়রানির কথা বলেন। এসব বলতে গিয়ে প্রায় প্রত্যেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। তাঁরা বলেন, এত দিন তাঁদের কষ্টের কথা বলতে দেওয়া হয়নি। পথে দাঁড়ালেই পুলিশি হামলা করে তুলে দেওয়া হয়েছে।
মানববন্ধনে অনেক স্বজনহারা মানুষের মধ্যে থেকে জামাল উদ্দিন বলেন ২০১৭ সালে তুলে নেওয়া তাঁর ছেলে ইশরাক উদ্দিনের কথা। তিনি বলেন, ছেলেকে হারানোর পর থেকে পরিবার থেকে সব আনন্দ, উৎসব হারিয়ে গেছে।
২০১৪ সালে গুম হওয়া আবদুল কাদেরের মা আয়েশা আলীর ছেলের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় গলা ধরে আসছিল। এক পর্যায়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। বলেন, ‘সবাই বলছে, দেশ নতুন করে স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু আমার জন্য এখনো দেশ স্বাধীন হয়নি। আমি আমার ছেলেকে ফিরে পাইনি। জানি না, সে বেঁচে আছে কি নাই।
ওয়ার্ড কাউন্সিলর চৌধুরী আলমের কন্যা মাহফুজা আক্তার মুক্তা বলেন, ১৫ বছর হলো তাঁর বাবা নিখোঁজ। তাঁদের পরিবারটাই বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। ড্রাইভার কাউসার এর মেয়ে কিশোরী লামিয়া আক্তার জানায়, ২০১৩ সালে তার বাবা কাওসার হোসেনকে যখন তুলে নেওয়া হয়, তখন তার বয়স ছিল ৩ বছর। বাবার মুখটা তার মনে পড়ে না। কাঁদতে কাঁদতে বাবার মুখটা দেখার আকুতি জানায় লামিয়া। সে বলে, ‘আমি বাবার মুখটা দেখতে চাই। বাবা বলে ডাকতে চাই।
সৈয়দা শাম্মি সুলতানা বলেন, ২০১৩ সালে তাঁর স্বামী খালেদ হাসানকে তুলে নেওয়ার পর থেকে শুধু কান্না নিয়েই দিন কাটছে তাঁর সংসারে। রিনা আলম বলেন ২০১৫ সালে তাঁর স্বামী নূর আলমকে তুলে নেওয়ার পর থেকে কত জায়গায় যে খোঁজ করতে ছুটে গেছেন সেই যন্ত্রণার কথা। তিনি বলেন, স্বামী যদি মারাও গিয়ে থাকেন, তাহলে অন্তত তাঁর কবরটি কোথায় আছে, তা জানতে পারলে সন্তানদের নিয়ে কবর জিয়ারত করতে পারতেন।
এভাবেই স্বজন হারানোর বেদনা ও কষ্টের কথা বলে তাঁদের মুক্তি দাবি করে বক্তব্য দিয়েছেন ছেলেহারা নূরুল ইসলাম, ভাইহারা মো. শহীদুল্লাহ, সন্তানহারা রেহেনা আক্তার, ভাইহারা সঈদুল ইসলাম, বাবাহারা মিম,ভাইহারা বোন শিপুসহ অনেকে। তাঁরা বলেন, স্বজনদের ফিরে না পেলে তাঁদের কাছে এই গণ-অভ্যুত্থান, এই নতুন স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে যাবে।
মায়ের ডাকের এই সমাবেশ ও মানববন্ধনে সংহতি প্রকাশ করতে এসেছিলেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের নেতারাসহ ব্যক্তিগতভাবেও অনেকে। তাঁদের মধ্যে বক্তব্য দেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পাটির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, এবি পার্টির যুগ্ম আহ্বায়ক তাজুল ইসলাম, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের কেন্দ্রীয় নেতা ফয়জুল হাকিম, মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের জ্যেষ্ঠ গবেষক তাসকিন ফহমিনা, আইনজীবী সারা হোসেন, সংগীতশিল্পী সায়ান, সাংবাদিক সায়দিয়া গুলরুখসহ অনেকেই।
বক্তারা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার ইতিমধ্যেই গুম হওয়ার তদন্ত করতে কমিশন গঠন করেছ এবং প্রধান উপদেষ্টা এ–সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কনভেনশনে স্বাক্ষর করেছেন। এটা খুবই আশাপ্রদ ঘটনা। যাঁরাই গুম-খুনের সঙ্গে জড়িত থাকুন না কেন, সবাইকে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক সাজা কার্যকর করতে হবে। দেশের সব ছাত্র-জনতা এই সরকারের সঙ্গে আছে। তাঁরা বলেন, দেশে কোনো এলিট ফোর্সের প্রয়োজন নেই। বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের সঙ্গে জড়িত এই র্যাব বাহিনী বিলুপ্ত করতে হবে। দেশে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। একটি মানবিক দেশ গঠন করতে হবে।
মো.মঞ্জুর হোসেন ঈসা’র পরিচালনায় আরও উপস্থিত ছিলেন গুম হওয়া ইসমাইল হোসেন বাতেন এর স্ত্রী নাসরিন জাহান স্মৃতি, মেয়ে ইনশা,সাজেদুল ইসলাম সুমন এর স্ত্রী নাসিমা আক্তার, মায়ের ডাক এর আফরোজা ইসলাম আখি, রাসের এর বোন লাবনী,লক্ষীপুর এর ওমর ফারুক এর ছেলে ইমন,পারভেজ হোসেন এর স্ত্রী ফারজানা আক্তার, মেয়ে হৃদিসহ প্রায় শতাধিক পরিবারের সদস্য।
সমাপনী বক্তব্যে মায়ের ডাকের সমন্বয়ক সানজিদা ইসলাম বলেন, ২০১৩ সালে তাঁর ভাইকে গুম করা হয়েছে। তখন থেকেই গুম হওয়া স্বজনদের নিয়ে এই সংগঠন গড়ে তোলা হয়। এত দিন তাঁরা তাঁদের বেদনার কথা বলতে পারতেন না। অবিলম্বে সব আয়নাঘর, সব বন্দিশালা ভেঙে ফেলার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, জনগণের অর্থে কোনো বাহিনী যেন কোনো বন্দিশালা গড়ে তুলতে না পারে, সে ব্যবস্থা করতে হবে। গুম হওয়া মানুষদের মুক্তি ও তাঁদের বিষয়ে সম্পূর্ণ তথ্য শ্বেতপত্র আকারে প্রকাশ করতে হবে।